ইসরায়েলের কাতার হামলা: জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদের তীব্র নিন্দা, হামাসের লড়াইয়ের প্রত্যাশা অটুট

ডিএসএফ নিউজ ডেস্করিপোর্টঃ মধ্যপ্রাচ্যের উত্তেজনা আরও তীব্র হয়ে উঠেছে ইসরায়েলের সাম্প্রতিক সামরিক অভিযানের কারণে। কাতারের রাজধানী দোহায় হামাসের শীর্ষ নেতাদের বিরুদ্ধে ইসরায়েলের হামলা আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে চাঙ্গা করে তুলেছে। জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদের সদস্যরা এই হামলাকে কড়া ভাষায় নিন্দা করে বলেছেন যে এটি কাতারের সার্বভৌমত্বের স্পষ্ট লঙ্ঘন এবং গাজায় চলমান যুদ্ধের শান্তি প্রক্রিয়াকে বিপন্ন করেছে। এদিকে, হামাস সংগঠন জানিয়েছে, তারা লড়াই চালিয়ে যাবে এবং তাদের মূল দাবিগুলো—যেমন গাজার সম্পূর্ণ সামরিক প্রত্যাহার, বন্দীদের মুক্তি এবং স্থায়ী যুদ্ধবিরতি—যে কোনোভাবেই পরিবর্তন হবে না। তারা ইসরায়েলের চলমান যুদ্ধকে ‘গণহত্যামূলক’ বলে অভিহিত করেছে।

ঘটনার পটভূমি: দোহায় হামলার বিবরণ

গত ৯ সেপ্টেম্বর দুপুরে কাতারের দোহার ওয়েস্ট বে ল্যাগুন এলাকায় একাধিক বিস্ফোরণের শব্দ শোনা যায়। স্থানীয় সাক্ষীরা বলছেন, ধোঁয়ার স্তম্ভ উঠে আকাশ ছুঁয়েছে এবং কয়েকটি আবাসিক ভবন মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। ইসরায়েলি প্রতিরক্ষা বাহিনী (আইডিএফ) দাবি করেছে, এটি ছিল একটি ‘সুনির্দিষ্ট অভিযান’ যাতে হামাসের রাজনৈতিক শাখার শীর্ষ নেতাদের লক্ষ্য করা হয়েছে। মূল লক্ষ্য ছিলেন খলিল আল-হায়্যা, হামাসের গাজা-ভিত্তিক প্রধান নেতা এবং জাহের জাবারিন, পশ্চিম তীরের নেতা। ইসরায়েলি প্রধানমন্ত্রী বেনজামিন নেতানিয়াহু বলেছেন, এই নেতারা ২০২৩ সালের ৭ অক্টোবরের হামলার সূত্রপাতকারী, যাতে ইসরায়েলে হাজারো মানুষ নিহত হয়। তিনি এই অভিযানকে ‘সম্পূর্ণ স্বাধীন’ বলে বর্ণনা করেছেন এবং বলেছেন, এটি হামাসের বিরুদ্ধে ইসরায়েলের অধিকারের অংশ।

হামাসের তরফে জানানো হয়েছে, অভিযানের সময় তারা মার্কিন মধ্যস্থতায় গাজায় যুদ্ধবিরতির প্রস্তাব নিয়ে আলোচনা করছিল। সংগঠনের একজন কর্মকর্তা বলেছেন, “এটি ছিল সম্পূর্ণ আলোচনা প্রক্রিয়ার উপর হামলা।” হামাস নিশ্চিত করেছে যে তাদের শীর্ষ নেতারা অক্ষত আছেন, কিন্তু ছয়জন মারা গেছেন—যাদের মধ্যে খলিল আল-হায়্যার ছেলে এবং তার অফিসের পরিচালক অন্তর্ভুক্ত। কাতার সরকার জানিয়েছে, হামলায় একজন তাদের নিরাপত্তা কর্মকর্তাও নিহত হয়েছেন। এই ঘটনা কাতারকে বিশেষভাবে ক্ষুব্ধ করেছে, কারণ দেশটি গাজা যুদ্ধে মধ্যস্থতাকারী হিসেবে পরিচিত এবং মার্কিন সেনাবাহিনীর বৃহত্তম ঘাঁটি আল উদেয়দ এখানে অবস্থিত।

 

জাতিসংঘের প্রতিক্রিয়া: সার্বভৌমত্বের লঙ্ঘন

জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদ ১১ সেপ্টেম্বর একটি জরুরি বৈঠকে এই ঘটনা নিয়ে আলোচনা করে। ১৫ সদস্যের ঐকমত্যে একটি বিবৃতি জারি করা হয়েছে, যাতে ইসরায়েলের হামলাকে ‘কাতারের সার্বভৌমত্ব এবং ভৌগোলিক অখণ্ডতার স্পষ্ট লঙ্ঘন’ বলে অভিহিত করা হয়েছে। যদিও বিবৃতিতে ইসরায়েলের নাম সরাসরি উল্লেখ করা হয়নি, কিন্তু এটি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সমর্থনেও গৃহীত হয়েছে, যা ইসরায়েলের ঘনিষ্ঠ মিত্র। জাতিসংঘের মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেস বলেছেন, “সকল পক্ষকে স্থায়ী যুদ্ধবিরতির দিকে কাজ করতে হবে, না যে এটি ধ্বংস করতে। কাতারের শান্তি প্রচেষ্টা অত্যন্ত ইতিবাচক ভূমিকা পালন করছে।”

কাতারের প্রধানমন্ত্রী শেখ মোহাম্মদ বিন আব্দুর রহমান আল থানি বৈঠকে অংশ নিয়ে বলেছেন, এই হামলা আন্তর্জাতিক শৃঙ্খলাকে চ্যালেঞ্জ করেছে এবং তারা তাদের মধ্যস্থতাকারী ভূমিকায় অটল থাকবে। পরিষদের নির্বাচিত সদস্য আলজেরিয়া, পাকিস্তান এবং সোমালিয়া এই বৈঠকের অনুরোধ করেছিল। পাকিস্তানের প্রতিনিধি বলেছেন, “শুধু নিন্দা নয়, ইসরায়েলকে জবাবদিহি করতে হবে।” এছাড়া, আরব লীগ, ইসলামী সহযোগিতা সংস্থা এবং গাল্ফ কো-অপারেশন কাউন্সিলও এই হামলাকে ‘অবৈধ আগ্রাসন’ বলে নিন্দা করেছে।

হামাসের অবস্থান: লড়াই চালিয়ে যাওয়ার ঘোষণা

হামাসের রাজনৈতিক ব্যুরোর সদস্য সুহাইল আল-হিন্দি বলেছেন, “আমাদের নেতারা অক্ষত, কিন্তু এই হামলা ইসরায়েলের শান্তি চাওয়ার অভাব প্রমাণ করে।” সংগঠন জানিয়েছে, তারা মার্কিন প্রস্তাবিত যুদ্ধবিরতির শর্তগুলো—যেমন ৬০ দিনের অস্থায়ী যুদ্ধবিরতি, বন্দী বিনিময় এবং গাজায় মানবিক সাহায্য—আলোচনা করছিল। কিন্তু তারা তাদের মূল দাবিগুলোতে অটল: ইসরায়েলের সম্পূর্ণ প্রত্যাহার, গাজার পুনর্নির্মাণ এবং স্থায়ী শান্তি। হামাসের মিডিয়া অফিসের পরিচালক ইসমাইল আল-থাওয়াবতা বলেছেন, “ইসরায়েলের এই গণহত্যামূলক যুদ্ধ আমাদের দৃঢ়তা বাড়িয়েছে। আমরা লড়াই চালিয়ে যাব যতক্ষণ না আমাদের লক্ষ্য অর্জিত হয়।”

গাজায় চলমান যুদ্ধে এর মধ্যে হাজার হাজার মানুষ নিহত হয়েছে, যার বেশিরভাগ নিরীহ নাগরিক। হামাসের দাবি, ইসরায়েলের অভিযান গাজাকে ধ্বংস করছে এবং মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধ।

আন্তর্জাতিক প্রতিক্রিয়া এবং ভবিষ্যতের উদ্বেগ

এই হামলা শুধু কাতারকেই নয়, সমগ্র অঞ্চলকে প্রভাবিত করেছে। সৌদি আরব, সংযুক্ত আরব আমিরাত এবং মিশরের মতো দেশগুলো কাতারের সাথে সংহতি জানিয়েছে। মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প বলেছেন, “আমি এই হামলা নিয়ে অসন্তুষ্ট,” এবং এটি শান্তি প্রচেষ্টাকে বাধাগ্রস্ত করতে পারে। ব্রিটেনের প্রধানমন্ত্রী কিয়ার স্টার্মার এবং কানাডার পররাষ্ট্রমন্ত্রীও নিন্দা করেছেন।

জাতিসংঘের রাজনৈতিক বিষয়ক উপ-সচিব রোজমেরি ডিকার্লো বলেছেন, এটি ‘অন্যায়কর উত্তেজনা’ যা গাজায় বন্দী মুক্তি এবং যুদ্ধবিরতির সম্ভাবনাকে বিপন্ন করছে। বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, এই ঘটনা মধ্যপ্রাচ্যে নতুন সংঘাতের সূচনা করতে পারে, বিশেষ করে যখন কাতার যুদ্ধবিরতির মধ্যস্থতায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে।

ইসরায়েলের প্রেসিডেন্ট ইসাক হার্জোগ বলেছেন,

“কখনও কখনও এমন লোকদের অপসারণ করা দরকার যারা চুক্তি করতে চায় না।” কিন্তু আন্তর্জাতিক চাপ বাড়ার সাথে সাথে, এই সংকটের সমাধান কতটা সম্ভব তা নিয়ে প্রশ্ন উঠছে। গাজায় শান্তি প্রক্রিয়া এখন আরও জটিল হয়ে পড়েছে, এবং বিশ্বের নজর এখন জাতিসংঘের পরবর্তী পদক্ষেপের দিকে।

Comments

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *